রণদেব মুখোপাধ্যায়,কাটোয়া:- ‘বারো ঘাট তেরো হাট তিন চণ্ডী তিনেশ্বর, একথা বলে যে জেনো তার ইন্দ্রাণীতে ঘর’।আগেকার দিনে দাঁইহাট বাণিজ্য নগরীর পরিচয় এলাকাবাসীরা এভাবেই দিত। শাঁখাই থেকে কাটোয়া হয়ে দাঁইহাট পর্যন্ত দীর্ঘ সাত মাইল পথে বারোঘাট এবং তেরোহাট আছে। ঘাট গুলি হল শঙখেশ্বরী ঘাট, মনোহারি ঘাট,কালুর ঘাট,স্বরূপ পানের ঘাট, কদমতলার ঘাট, ইন্দ্রেশ্বর ঘাট, বক্সির ঘাট, গণেশমাতার ঘাট, দেওয়ানের ঘাট,শিবের ঘাট, কান্তবাবুর ঘাট,বারদুয়ারি ঘাট। বারদুয়ারি ঘাটের অষ্টাদশ শতাব্দীর তিনের দশকে নাম হয় বুড়োরানির ঘাট।ভাগীরথী নদী তীরবর্তী এই ঘাটের লাগোয়া কয়েক শতক জমির উপর বর্ধমান রাজপরিবারের তরফে আনুমানিক ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে একটি চার কামরার গঙ্গা আবাস নির্মাণ করা হয়েছিল।বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ রায় গঙ্গা আবাস নির্মাণের পর ঘাটের নাম পরিবর্তন হয়ে বুড়োরানির ঘাট নামে পরিচিত হয়েছিল। বর্ধমানের রাজপরিবারের সদস্যরা দাঁইহাটের ভাগীরথী নদীতে পুণ্যস্নান থেকে শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম সহ শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য দাঁইহাটের ভাউসিং এলাকায় আসা যাওয়া করতেন। ভাউসিং এলাকায় এই ঘাটের নিচ দিয়ে একসময় ভাগীরথী বয়ে যেত।এখানে সমাজবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে বুড়োরানির ঘাটে একটি স্থাপত্য দেখা যায় সেটা আদপে বর্ধমান রাজপরিবারের গঙ্গা আবাসের অংশ বিশেষ। এই স্থাপত্যকে অনেকে ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গামণ্ডপের অংশবিশেষ বলে উল্লেখ করেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। মারাঠা দস্যুরা বাংলায় লুঠতরাজ করেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছে,নির্বিচারে অত্যাচার করেছে কিন্তু কোথাও মন্দির তৈরি করেনি। ‘চৌথা’ কর আদায়ের জন্য বর্গিরা সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে বাংলায় এসেছিল। তাহলে এই ঘাটের লাগোয়া বর্ধমান রাজার তৈরি গঙ্গা আবাসের ধ্বংসাবশেষকে ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গা মন্দির বলছে কেন? কারণ ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ভাস্কর পণ্ডিত তার আরাধ্য মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি পুজো দাঁইহাটের বুড়োরানির ঘাটের কাছে করেছিল বলে অনেকে দাবি করেন।একথা সত্য যে সোনার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি ভাস্কর পণ্ডিতের আরাধ্য দেবী ছিলেন।ভাস্কর পণ্ডিত যেখানেই যেতেন সঙ্গে আরাধ্য দেবীকে নিয়ে যেতেন বলে জানা যায়। কিন্তু এই তথ্যের ভিন্ন মত পাওয়া যায়।ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার সহ অন্যান্য গবেষকদের দাবি ভাস্কর পণ্ডিত দুর্গা পুজো করেছিল একথা ঠিক, কাটোয়ার সন্নিকটে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী কোন এক স্থানে। কিন্তু গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে বলা হয়েছে…
‘একা ভাস্কর লইয়া কিছু শুন বিবরণ।
জেরুপে ডাঞিহাটে কৈলা পূজা আরম্ভন’।
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনে নিই ভাস্কররাম পণ্ডিত দাঁইহাটে বুড়োরানির ঘাটে রাজাদের গঙ্গা আবাস দখল করে সেখানে দুর্গাপুজো করেছিল তার মানে কি এই স্থাপত্য ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গামন্দির হয়ে যায়? বর্ধমান বংশানুচরিতের লেখক রাখালদাস মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া তথ্যে বুড়োরানির ঘাটে রাজ পরিবারের মহিলাদের জন্য তৈরি গঙ্গা আবাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।রাজপরিবারের সদস্যরা এই ঘাটে পুণ্যস্থান শেষে গঙ্গা আবাস ব্যবহার করতেন এমন নজির আছে। রাজ্যে বর্গি হামলার পর বর্ধমান রাজ পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে মহিলারা দাঁইহাটের সমাজবাড়ি এলাকাকে এড়িয়ে চলত। সেজন্য কাটোয়া সহ সম্পূর্ণ এলাকা রাজ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে গবেষকদের দাবি।
১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে বর্গি দস্যুরা মুর্শিদাবাদ হয়ে কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটের ভাউসিং এলাকায় ডেরা গেড়েছিল। ভাউসিং এলাকাকে অস্থায়ী রাজধানী করে বর্গিরা ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ে অবাধে লুটতরাজ চালাত।লুটের সামগ্রী ভাউসিং এলাকায় অস্থায়ী আস্তানায় রাখা হত। এমনকি বর্গি দস্যুদলের অনেকে গ্রাম থেকে মহিলাদের তুলে আনত বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর অষ্টমী তিথির ভোরে নবাব আলীবর্দির সৈন্যদল অতর্কিতে ভাস্কর পণ্ডিতের উপর হামলা করলে ভাস্কর পণ্ডিত সোনার দুর্গা ভাগীরথীতে অকাল বিসর্জন দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দলবল নিয়ে বর্ধমান সড়ক ধরে মেদিনীপুর হয়ে উড়িষ্যার দিকে পালায়।আলীবর্দির সৈন্যদল ভাস্কর পণ্ডিত সহ দস্যুদলকে বর্ধমান পর্যন্ত তাড়া করেছিল। আলীবর্দী নদীয়ার বসতপুরের কাছে ভাগীরথী নদীর উপর নৌকা সাজিয়ে ‘পল্টুন’ সেতু তৈরি করে দাঁইহাটের ভাউসিং এলাকার বর্গী দস্যুদলের উপর হামলা করেছিল বলে জানা যায়।অতর্কিত হামলায় মারাঠা যোদ্ধা ভাস্কর পণ্ডিত বেসামাল হয়ে পড়েন।প্রাণ বাঁচাতে পিছটান দেয়।
বাংলার ছড়াগানের যে ‘বর্গির’ কথা শোনা যায় তা আদপে মারাঠা দুর্বৃত্তের দলকে বলা হয়েছে। ‘বর্গি’ শব্দটা এসেছে ফারসির ‘বারগিস’ শব্দ থেকে, যার অর্থ হল ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’। মারাঠা দস্যুদের হাতে থাকত তীক্ষ্ণফলা যুক্ত লম্বা বর্শা। মারাঠা জাতি শুধু ভারতের মহারাষ্ট্রে আছে তা নয় দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত জুড়েই মারাঠা জাতি ছড়িয়ে আছে । ‘বর্গি’ শব্দের উৎসের ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। মারাঠাদের একটি সম্প্রদায় যে কোন অভিযানে যাওয়ার সময় একটি কয়েক হাত লম্বা বর্শা সঙ্গে করে বের হত।’বর্শা’কে মারাঠি ভাষায় বলা হয় ‘বরচি’। বরচি নাম থেকে ধনগররা বারগির, বর্গা ধনগর বা ‘বর্গি’ নামে পরিচিত হয়। ‘বর্গি’ শব্দটি মারাঠি ‘বারগির’ শব্দের অপভ্রংশ বলে অনেকে মনে করেন।
যারা বছরের কয়েক মাস বাংলায় এসে অবাধে লুটতরাজ করত। যারা নির্বিচারে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছে, ঘর-বাড়ি তছনছ করে নারীর সম্ভ্রম লুট করেছে, মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে তারা বাংলায় মন্দির নির্মাণ করবে এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? বাংলার কোথাও মারাঠা দস্যুদের কোন স্থাপত্যের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। দাঁইহাটের বুড়োরানির ঘাটের বর্ধমান রাজপরিবারের গঙ্গা আবাসের চাতালে দুর্গা পুজো আজও হয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এলাকার বাসিন্দারা ঘটা করে দুর্গাপুজো শুরু করেছিল। বর্তমানে পাড়ার মহিলারা এই দুর্গাপুজো পরিচালনা করে থাকেন। সেই দুর্গাপুজোর সঙ্গে মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিতের নাম জড়িয়ে যায়।