রণদেব মুখোপাধ্যায়,কাটোয়া:- জঙ্গলের আলোছায়াময় থেকে মননের উৎসার। এমনটাই সম্ভব হয়েছিল পূর্বস্থলীর বহড়া গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ায়। নদীখাত পেঁচানো ছোট-বড় উঁচুনিচু নানা গাছের ভিড়ের মধ্যিখানে মাথা তুলেছিল ছাপাখানা। নাম বহড়া ছাপাখানাডাঙা। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নামে এক গ্রন্থপাগল যুবকের হাত ধরে বাঙালিকে বাংলা পড়ানোর জন্য অজগাঁয়ের বুকে গড়ে তুলেছিলেন মুদ্রণালয়। রবি ঠাকুরের গানের মতন, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। পুঁথির সনাতন ঘরানা ভেঙে বাংলাভাষায় পত্রপত্রিকা, বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ শুরু হল। ইচ্ছেপূরণ হল আমপাঠকের। অন্ধকার ভেঙে আলোর অক্ষরমালায় উদ্ভাসিত হল বাঙালির মনীষা। বাংলা পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থ প্রকাশের পথিকৃৎ হিসেবে বাংলার সারস্বত সমাজ গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্যকে বরণ করে নিল। আনুমানিক ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পূর্বস্থলীর বহড়া গ্রামে মিশনারী পাদরিদের বিলি করা বাংলা পুস্তক হাতে পেয়ে পাঠশালার পণ্ডিত গঙ্গাকিশোর এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। নিজের পছন্দের কাহিনিকে বাংলা পুস্তক হিসেবে বাঙালির ঘরে পৌঁছানো। বাংলা পুস্তক বা বই ছাপতে গেলে ছাপাখানার কাজ জানতে হবে। ধর্মপুস্তক বিলির করতে আসা পাদরিদের জিজ্ঞাসা করে গঙ্গাকিশোর জানতে পারেন শ্রীরামপুরের মিশনারী ছাপাখানা থেকে বাংলা বই ছাপা হচ্ছে। ছাপাখানার কাজ শেখার ইচ্ছা কথা জানতে পেরে একজন পাদরি গঙ্গাকিশোরকে শ্রীরামপুর মিশনারীতে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। বহড়া গ্রামের বাসিন্দা সংস্কৃত পণ্ডিত কৃষ্ণনগরের রাজার পুরোহিত বাল্যবন্ধু ত্রয়োনিধি মুখোপাধ্যায়ের কাছে গঙ্গাকিশোর ছাপাখানার কাজ শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বন্ধু গঙ্গাকিশোরের ইচ্ছা পূরণে রাজপুরোহিত ত্রয়োনিধি কৃষ্ণনগরের রাজা গিরীশ চন্দ্রের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। সেইসময় কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের সুসম্পর্ক ছিল। শ্রীরামপুরের মিশনারী ছাপাখানার কাজের জন্য বাংলা,সংস্কৃত ও ইংরাজি ভাষায় দক্ষ পণ্ডিত মানুষের প্রয়োজন ছিল।রাজা গিরীশচন্দ্রের সুপারিশে গঙ্গাকিশোর সবেতন শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনারীর ছাপা খানায় কাজে যোগ দেন। সেইসময় শ্রীরামপুর ডেনিশ সরকারের অধীনে ছিল।তখন ব্যাপটিস্ট মিশনারী পরিচালনা করতেন বাংলা ভাষানুরাগী কয়েকজন ভিনদেশি পণ্ডিত ব্যক্তি। যোশুয়া মার্শম্যান, ফেলিক্স কেরী উইলিয়াম ওয়ার্ড ব্যাপটিস্ট মিশনারী থেকে বাংলা ভাষায় ধর্মপুস্তক ছেপে সারা বাংলায় বিলি করার কাজে ব্রতী হয়েছেন। গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্য গুণী মানুষের কাছে ছাপাখানার কাজ শিখতে শুরু করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই গঙ্গাকিশোর নিজের চেষ্টায় ছাপাখানার কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। বাংলা, ইংরাজি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য মেধার জোরে শ্রীরামপুর মিশনারী ছাপাখানায় কর্মকর্তাদের সুনজরে পড়েন। শোনা যায় যোশুয়া মার্শম্যানের ছেলে জন ক্লার্ক মার্শম্যানকে কিশোর বয়েস থেকেই বাংলাভাষায় জ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাড়িয়েছিলেন গঙ্গাকিশোর। গঙ্গাকিশোরের সান্নিধ্যে কিশোর বয়সের জন ক্লার্ক মার্শম্যান বাংলা ভাষায় অসামান্য ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। কেরীর মানসপুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান বাংলা ভাষার সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতিকে আত্তীকরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে জন ক্লার্ক মার্শম্যানকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীরামপুর মিশন পরিচালক গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য নির্বাচিত করা হয়। এর তিন বছর আগে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের শ্রীরামপুর মিশনে থাকাকালীন জুলাই মাসে গঙ্গাকিশোর কলকাতার ফেরিস এন্ড কোম্পানি থেকে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল সচিত্র কাব্য মুদ্রিত করেন। সচিত্র অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ দিয়ে গঙ্গাকিশোরের স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু হয়। গঙ্গাকিশোর ছাপাখানার একজন দক্ষ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন, নিজেই ব্লক, টাইপ তৈরি করতে পারতেন। বাঙালি লেখকের প্রথম সচিত্র পুস্তক ছিল অন্নদামঙ্গল কাব্য।প্রকাশনায় বাঙালির গর্বের দিন শুরু হল।১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে গঙ্গাকিশোর ফেরিস এন্ড কোম্পানি থেকে আরও একটি বই মুদ্রিত করেন।” এ গ্রামার ইন ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি” নামে বইটি ইংরাজির বর্ণমালা এবং বর্ণ তথা শব্দের উচ্চারণ দেওয়া হয়।বইটির প্রাপ্তিস্থান হিসেবে ঠিকানা দেওয়া হয় কলকাতা অফিস কিংবা শ্রীরামপুর কাছারি বাড়ি।বাঙালির ঘরে বই পৌঁছে দিতে তিনি গ্রামে-গঞ্জে কমিশন ভিত্তিতে প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। এরইমধ্যে আরও কিছু শাস্ত্রীয় পুস্তক
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা
গঙ্গাকিশোর ছাপলেন।বাংলা বইয়ের বিক্রি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। পুস্তক ব্যবসা যখন জমে উঠল তখন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার চোরবাগানে দপ্তর সহ বিক্রয়কেন্দ্র খুললেন গঙ্গাকিশোর। বাঙালির প্রথম পুস্তক ব্যবসায়ী হিসেবে কলকাতার বুকে পরিচিতি পেল গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। দায়াধিকার অশৌচ এবং প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ে খান কয়েক পুস্তক তখন বাংলার পুরোহিত সমাজে বা পণ্ডিত মহলে খুবই চাহিদা হল।
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে বন্ধুবর হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র কোনটি সেবিষয়ে মতান্তর আছে।সমাচার দর্পন না বঙ্গাল গেজেটি। প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হিসেবে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের প্রকাশিত বেঙ্গল গেজেটিকে ধরা হয়।১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে বঙ্গাল গেজেটি পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও এখনও পর্যন্ত গঙ্গাকিশোরের বঙ্গাল গেজেটির প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার হদিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রাচীন কোন গ্রন্থাগারেও বঙ্গাল গেজেটি পত্রিকার খোঁজ মেলেনি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের জীবন চরিতটি আসল আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে গঙ্গাকিশোরের বঙ্গাল গেজেটি পত্রিকার কথা পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ প্রমাণ হিসেবে গঙ্গাকিশোরের সহযোগী হরচন্দ্র রায় প্রকাশিত দুটি বিজ্ঞাপনের কথা তুলে ধরেছেন।মে মাসে প্রকাশিত প্রথম বিজ্ঞাপনটি হল, Hurrochunder Roy begs leave to inform … he has established a Bengalee Press … intends to publish a Weekly Bengal Gazette…Hurrochunder Roy ,145 Chorbagan Street price Rs 2 per month ( Govt Gazette , 14th May 1818) দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনটির প্রকাশকাল ৯ জুলাই ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ। প্রেস প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং শুক্রবার পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, Having established a Bengalee Press and a Weekly Bengal Gazette ,which he publishes on Friday .. Subscribers.. to send..Hurrochunder. বিজ্ঞাপণের কোথাও গঙ্গাকিশোরের নাম উল্লেখ না থাকলেও গঙ্গাকিশোর যে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সে তথ্য প্রমাণ আছে। গঙ্গাকিশোর ছিলেন হরচন্দ্র রায়ের অংশীদার। এর থেকে এটা প্রমাণ হয় গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের বেঙ্গল গেজেটি হল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। গঙ্গাকিশোরের একসময়ের সঙ্গী জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদিত সমাচার দর্পন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে শ্রীরামপুর মিশনারী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।সর্বজনস্বীকৃত এই তথ্য নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। বিতর্ক উঠেছে গঙ্গাকিশোর সম্পাদিত বঙ্গাল গেজেটির প্রকাশকালকে নিয়ে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে-র ওরিয়েন্টাল স্টার জার্ণালের সংখ্যার উদ্ধৃতি দিয়ে এশিয়াটিক জার্নালের ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি সংখ্যায় লেখা হয়, Amongst the improvements which are taking place in Calcutta, we observe with satisfaction that the publication of Bengalees Newspapers has been commenced. যেহেতু ১৬ মে সমাচার দর্পন প্রকাশিত হয়নি বলে ওরিয়েন্টাল স্টার জার্ণালের উদ্ধৃতিকে মান্যতা দিয়ে এশিয়াটিক জার্নাল সাফ জানাল গঙ্গাকিশোর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে বঙ্গাল গেজেটি হল বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র এবিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারেনা। যদিও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের অভিমত ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে পত্রিকা প্রকাশ হল আর ১৬ মে বঙ্গাল গেজেটির সমালোচনা ওরিয়েন্টাল স্টার জার্নালে প্রকাশিত হল এটা অস্বাভাবিকতা বা গোলমালমনে হচ্ছে। যাই হোক বাংলা সংবাদপত্রের গর্বের দিন হল ১৫ মে। এইদিনটি বর্ধমানবাসী সহ বহড়া গ্রামবাসীরা বহড়া ছাপাখানা ডাঙ্গায় গঙ্গাকিশোর স্মরণ উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।ভাষাবিদ সুকুমার সেন গঙ্গাকিশোরকে পুস্তকপ্রকাশকদিগের ব্রহ্মা বলতেন। মিশনের বাংলায় ধর্ম পুস্তিকা প্রকাশনা দেখে আম বাঙালির ঘরে নিজ ধর্মের কাহিনিকে বাংলা ভাষায় ছেপে পুস্তক আকারে পৌঁছানোর তাগিদে গঙ্গাকিশোর গ্রাম ছেড়েছিলেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভের পর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কলকাতার চোরবাগানে নিজস্ব প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুস্তক ব্যবসায়ে অংশীদার ছিলেন বহড়া গ্রামের সন্তান বন্ধু হরচন্দ্র রায়। বাংলা পুস্তকের বিক্রি দেখে বঙ্গাল গেজেটির কার্যালয় থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীবৈকুণ্ঠনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
তৃতীয় পৃষ্ঠা
অষ্টাদশ অধ্যায়ের শ্রীমদভগবদগীতা ছাপানো হয়েছিল। বাংলার গ্রামের পুস্তক এজেন্টরা এই বই বিক্রি করতেন। তখন ট্রেন ছিল না, পরিবহণের সমস্যা থাকলেও গঙ্গাকিশোর জলপথে নৌকাযোগে বাংলার
অধিকাংশ স্থানে বাংলায় ছাপানো বই সরবরাহ করা হত।গঙ্গাকিশোর নিজে অগ্রদ্বীপ থেকে নৌকা করে ভাগীরথী নদীপথ ধরে কলকাতা যাতায়াত করতেন। এত প্রতিকুলতার মধ্যে সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে গঙ্গাকিশোরকে সাহায্য করেছে বন্ধু হরচন্দ্র রায়। ভারতে বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্রের জনক গঙ্গাকিশোর সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর কলকাতার আরও দুই পুস্তক ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ দেব ও লাল্লুজি ব্যবসায়িক প্রতিযোগী হয়ে উঠেছিলেন।প্রথম দিকে বিশ্বনাথ দেব ও লাল্লুজি দুজনেই সাধারণত পাঠ্যপুস্তক , আইনি অনুবাদ , শাস্ত্রীয় কথন ইত্যাদি ছাপতেন। লাল্লুজি ছাপতেন রামমোহন রায়ের বই ,বিশ্বনাথ দেবের আদিরসাত্মক বইয়ের উপর আগ্রহ ছিল বেশি। বিশ্বনাথ দেবের প্রকাশিত বইগুলি হল রসমঞ্জরী, রতিমঞ্জরী, বিদ্যাসুন্দর আদিরস প্রভৃতি রগরগে বাংলা বই। যদিও বিশ্বনাথ দেব প্রথমদিকে শব্দসিন্ধুর মত গুরুগম্ভীর বই ছেপেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় শব্দসিন্ধুর চেয়ে বিদ্যাসুন্দর বা রতিমঞ্জরীর বিক্রি বেশি হয়েছিল। ১৮১৯ সালে গঙ্গাকিশোরের প্রকাশনা ব্যবসার সমৃদ্ধি ঘটল ঠিকই কিন্তু শুরু হল অংশীদারের সঙ্গে অশান্তি। কী ধরনের পুস্তক ছাপা হবে আর এজেন্টরা বিক্রয়মূল্যের উপর কত শতাংশ কমিশন পাবে এই নিয়ে হরচন্দ্রের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে বাঙালির পুস্তক ব্যবসা ভেঙে গেল। গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্য কলকাতার চোরবাগান থেকে ছাপাখানার সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে ভাগীরথী নদীপথ ধরে নৌকাযোগে অগ্রদ্বীপের ফেরিঘাট হয়ে সাইনির বিল ধরে ছাপাখানার যন্ত্র ও সরঞ্জাম সহ নৌকা নিজগ্রাম বহড়ায় পৌঁছায়। এই তথ্যের প্রমাণ হিসেবে তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে গঙ্গাকিশোরের একটি নিরীহ আবেদন। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা এপ্রিল কাউন্সিল চেম্বারে চিফ সেক্রেটারির স্বাক্ষর সম্বলিত আদেশনামা থেকে জানা যায় গঙ্গাকিশোর নিজের গ্রাম অখণ্ড বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের সন্নিকটে বহড়াগ্রামে বঙ্গাল গেজেটি প্রেস স্থাপন করবেন।”..M.L.Bayley having submitted to Government Gangakeysore Bhattacharji’s application to be permitted to carry with him to ‘Buhurraw’ near “Moorshidabad” his Printing Press,has been authorised to inform Gangakeysore that Government are not aware of any objection to his carrying his intentions into effect…….”
ভারত সরকারের প্রশাসনিক আদেশনামায় অগ্রদ্বীপের বহড়া গ্রামকে মুর্শিদাবাদের সন্নিকট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। আদেশনামার বয়ানের ফলে বহড়াগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল। পরে অবশ্য বহড়ার গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে ওঠা সমস্যার সমাধান করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’ বইয়ে, সেইসময় নবাবদের রাজধানী হিসেবে ইংরেজ শাসকের দল মুর্শিদাবাদকে জানতেন। অগ্রদ্বীপের অবস্থান ছিল মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বলেই প্রশাসনিক ভাবে অগ্রদ্বীপের বহড়া গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান বোঝাতে গিয়ে মুর্শিদাবাদ লেখা হয়েছিল। বহড়ার নিজ বাড়ি সংলগ্ন ডাঙ্গাতেই একটি পাকা ইঁটের ঘর নির্মাণ করে বঙ্গাল গেজেটি প্রেস স্থাপন করেন। বহড়া থেকেই বই ছাপা শুরু করেন। কলকাতার চোরবাগানের বইয়ের দোকান তথা কার্যালয়টি পুস্তকের মোকাম হিসেবে ব্যবহার করা হত। বহড়া ছাপাখানা থেকে একাধিক বাংলা বই প্রকাশিত হতে শুরু করল। ছাপা বইগুলি অগ্রদ্বীপের ঘাট থেকে নৌকাযোগে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা হত। বই ছাপা, বাঁধাই ও বিক্রিতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠল।
১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেণ্ডস অব ইণ্ডিয়া লেখা হয় “…. The compiler of the Almanack is Gungadhur. It is printed in the country near Ugrudweep, at a press which was, we believe, the First ever established among the natives. It is dedicated under God, to the Raja of Krisna Nagar whose family now reduced to poverty, were formerly the greatest patron of literature of Bengal . তাহলে বহড়ায় ছাপাখানায় বর্ষপঞ্জি ছাপা হত। বাংলা পঞ্জিকার ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম কিনা সেবিষয়ে কাতও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়না। গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্য প্রত্যন্ত গ্রামে বসে
চতুর্থ পৃষ্ঠা
ছাপাখানার কাজ চালিয়ে গিয়েছে। বহড়া গ্রাম থেকে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন বাংলা গ্রন্থ ছাপিয়ে বিক্রি করেছেন গঙ্গাকিশোর। বহড়া ছাপাখানা থেকে ছাপা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল ” এ গ্রামার ইন ইংলিশ এন্ড
বেঙ্গলি” অভিনব এই ব্যাকরণ বইয়ে অর্থ উচ্চারণ সহ প্রথম থেকে সপ্তম বর্ণ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় তর্জমা করা হয়েছে। এছাড়াও আছে গণিত নামতা ব্যাকরণ লিখবার আদর্শ নিধি। চামড়া বন্ধ জেলদা করা হিতোপদেশও ছাপা হয়েছিল মূল্য ছিল তিন টাকা। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘দায়ভাগ’ ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘চিকিৎসার্ণব’ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমদভাগবত প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এলাকার গুণীজনরা বলেন, বহড়া থেকে নাকি বাঙ্গাল গেজেটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। কারণ গঙ্গাকিশোর ছিলেন প্রগতিবাদী লেখক। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা লোপের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। দুঃখের ও পরিতাপের বিষয় অনেক দলিল দস্তাবেজ পাওয়া গেলেও বেঙ্গল গেজেটির কোন কপি বহড়ার ছাপাখানা ডাঙ্গা থেকে পাওয়া যায়নি। গঙ্গাকিশোর বহড়া গ্রামের প্রেস থেকে সবসময় রুচিশীল বই মুদ্রণ করতেন। তিনি নিজে ভালো ইংরাজি ,সংস্কৃত ভাষা জানতেন, জানতেন বাংলা ভাষা। নিজেই ছিলেন লেখক, সাংবাদিক পুস্তক ব্যবসায় বা প্রকাশনায় কাজে এটা ছিল তাঁর অতিরিক্ত সুবিধা। অন্য লেখকের বই ছাড়াও নিজের লেখা অসংখ্য বই বহড়া ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হতে লাগল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসার্ণব প্রকাশের সময় বইয়ের মধ্যেই কবিতা আকারে তাঁর আত্মপরিচয় দেওয়া ছিল।বহড়া ছাপাখানা থেকে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কর্তৃক রচিত দ্রব্যগুণ ভাষা প্রকাশিত হয়। বাংলার প্রসিদ্ধ পাঁচালিকার জনকবি দাশরথি রায় বহড়ার পার্শ্ববর্তী পীলা গ্রামে বসবাস করতেন। গঙ্গাকিশোরের থেকে কয়েক বছরের ছোট দাশরথি রায়ের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে দাশরথি রায়ের পাঁচালির কয়েকটা অধ্যায় নাকি গঙ্গাকিশোর নিজে ছেপেছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে মতান্তর আছে। তবে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দাশরথি রায়ের পাঁচালি বহড়া ছাপাখানা থেকে ছাপা হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক পণ্ডিত দাবি করেন দাশরথি রায় জন্মসূত্রে পীলার বাসিন্দা। বসতভিটা ছিল কাটোয়ার বাঁধমূড়া গ্রামে। কিন্তু দাশরথি বাল্যকালে পড়াশোনা করেছেন বহড়ার পাঠশালা থেকে।দাশরথির পাঁচালি পড়ে জানা যায় বহড়ার হরকিশোর ভট্টাচার্যের কাছে ইংরাজি পড়তেন দাশরথি রায়। অনেকে দাবি করেন গঙ্গাকিশোরের নাম ভুল বশত হরকিশোর ছাপা হয়ে থাকতে পারে। কারণ গঙ্গাকিশোর বহড়ার পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন।তিনি ইংরাজি পড়াতেন। এই তথ্যের ভিত্তি নেই। কারণ দাশরথি রায়ের জন্ম ১২১২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে। গঙ্গাকিশোর ভাগ্যান্বেষণে বহড়া গ্রাম ছেড়েছিলেন ১২১৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে।দাশরথির তিনবছর বয়সকালে গঙ্গাকিশোর গ্রাম ছেড়েছিলেন। হরকিশোর ভট্টাচার্য নামে এক পণ্ডিত ছিলেন। যদিও অনেক পরে গঙ্গাকিশোর যখন গ্রামে ফিরে আসেন এবং ছাপাখানা খুলে ব্যবসা শুরু করেন তখন দাশরথি রায় বাংলার ডাকসাইটের পাঁচালিকার হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন।
বহড়া ছাপাখানা থেকে বছরের পর বছর নানান ধরনের ধর্মপুস্তক যেমন প্রকাশ পাচ্ছিল তেমনই কলকাতার চোরবাগানের হরচন্দ্র রায়ের প্রেস থেকে বাংলা বই প্রকাশ পাচ্ছিল। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার হরচন্দ্রের চোরবাগান ছাপাখানা থেকে রামরত্ন ন্যায় পঞ্চাননের ভগবতী গীতা প্রকাশ পায়। সারা বাংলায় রামরত্ন ন্যায় পঞ্চাননের বইয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও হরচন্দ্রের প্রেস থেকে চৌরপঞ্চাশিকা, চানক্যকৃত হিতোপদেশ সূচক পুস্তক ছাপা হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলায় পুস্তক ব্যবসায়ের পথিকৃত গঙ্গাকিশোর যেমন থেমে ছিল না ঠিক তেমনই হরচন্দ্র রায় ছিলেন সমান কৃতী পুরুষ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এদেশে ছাপাখানা এসেছিল। তখন থেকেই বাংলা বই ছাপা শুরু হয়েছিল। সব বাংলা বই ছাপা হয়েছিল প্রয়োজনের তাগিদে। ধর্মপুস্তক, ব্যাকরণ, আইন সংক্রান্ত, অভিধান,শব্দকোষ ইত্যাদী বই ছিল উল্লেখযোগ্য।সব বইয়ের ছিলেন বিদেশি। ঊনিশ শতকের প্রথম বছরেই কলকাতায় শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা হয়। খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের জন্য মিশন কর্তৃপক্ষ বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগী হয়ে ওঠে। সেসময় ধর্ম পুস্তক, পাঠ্যপুস্তক ছাপা হত। বই পড়ে বাঙালির মন ভরত না। সাধারণের মনের খোরাক জোগাতে
পঞ্চম পৃষ্ঠা
শুরু হল আদিরসাত্মক বই ছাপা। বিচিত্র স্বাদের বই প্রকাশ হতে শুরু হল। কলকাতায় ছাপাখানা গড়ে উঠল। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি সমাচার দর্পনের উল্লেখিত তথ্য অনুসারে জানা যায় শেষ দশ বছরে দশ হাজার বই ছাপা হয়েছে। যদিও মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থগুলির বড় অংশ হল আদিরসাত্মক। ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়ার পাওয়া তথ্য অনুসারে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ টি বইয়ের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে চারটি আদিরসাত্মক বই রসমঞ্জরী, রতিমঞ্জরী, শৃঙ্গারতিলক, আদিরস এগুলি মানুষ টাকা দিয়ে কিনেছেন। দশ বছরে ১৬ হাজার বাংলা বই ছাপা হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পুস্তক ব্যবসায়ের আদিপুরুষ গঙ্গাকিশোর অন্নদামঙ্গল ছাপিয়ে বাংলার মানুষের মনজয় করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গীতগোবিন্দ, লক্ষীচরিত, বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রভৃতি বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। সেসময় কলকাতার চোরবাগানে রামকৃষ্ণ মল্লিকের প্রেস,মথুরানাথ মিত্রের প্রেস ও শিয়ালদহে পীতাম্বর সেনের প্রেসের আদিরসাত্মক বইয়ের পাশাপাশি বিদ্যাসুন্দর বা ধর্মপুস্তক, কাহিনি ছাপা হত। তবে বহড়া ছাপাখানার বইয়ের কাটতি বেশি ছিল। লঙ সাহেবের লেখা থেকে জানা যায় কলকাতার বাবুরা গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্যকে আদিরসাত্মক বইছাপার ফরমায়েশ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেসময় বইয়ের সঙ্গে ছবির কদর ছিল। গঙ্গাকিশোর প্রথম অন্নদামঙ্গল কাব্য সচিত্র প্রকাশ করে অন্য প্রকাশকদের বিড়ম্বনায় ফেলেছিলেন।
অকৃতদার গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য দীর্ঘসময়ের নৌকা যাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েন।বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন বলে জানা যায়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের পর বহড়া ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বইয়ে গঙ্গাকিশোরের নাম না থাকায় সকলের অনুমান ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়। যদিও এই তথ্যের কোন লিখিত প্রমাণ নেই। তবে তাঁর মৃত্যুর পর বহড়ার ছাপাখানা চালু ছিল। গঙ্গাকিশোরের ভাগ্নে মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসের উত্তিরাধিকার পেয়ে কাজ শুরু করেন। বর্ধমানের রাজার সভাপণ্ডিত ছিলেন মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সভাপণ্ডিত থাকার সুবাদে রাজপরিবারের সদস্য পরাণ চাঁদ কাপুর (তেজচন্দ্রের শ্যালক, পরে শ্বশুর হয়েছিলেন) বহড়ার ছাপাখানা থেকে নানান ধরনের গ্রন্থ ছাপিয়েছিলেন।বর্ধমান রাজ পরিবারের অর্থ সমন্ধীয় কাগজ বহড়া গ্রামের বঙ্গাল গেজেটি প্রেস থেকে ছাপা হত। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে বর্ধমান রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি ধর্মগ্রন্থ বহড়া থেকে ছাপা হয়েছিল। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে একটি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাপা হয়েছিল। গঙ্গাকিশোরের মৃত্যুর পর যে প্রেস চালু ছিল তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায়… ‘গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য মহাশয়স্য বাঙ্গাল গেজেটি যন্ত্রালয়ে শ্রীমহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা শ্রী ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়স্যামুমত্যনুসারে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাপা হইল’। অর্থাৎ ভাগ্নে মহেশচন্দ্র বঙ্গাল গেজেটি প্রেস চালু রেখেছিলেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ামের আদেশক্রমে মহেশচন্দ্রের পুত্র নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেস চালু রেখেছিলেন সে প্রমাণ বর্ধমান রাজপরিবারের নথিতে পাওয়া যায়। ১৮৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি বহড়ার বঙ্গাল গেজেটি প্রেস সচল ছিল। তবে নীলমণির পুত্র সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেস চালু রাখার তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। গ্রামে জনশ্রুতি আছে একুশ পৃষ্ঠার নারায়ণের পাঁচালি বঙ্গাল গেজেটি প্রেসে বিংশ শতকের শুরুর দিকেও পাওয়া গিয়েছিল। বর্ধমান রাজপরিবারের ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের পাওয়া একটি নথি থেকে জানা যায় বাংলা ও ইংরাজির খাজনার রসিদ বঙ্গাল গেজেটি প্রেসে ছাপা হয়েছিল। সেরকম কিছু রসিদ পাওয়া যায়। গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্যের যাবতীয় নথি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের রেখে যাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় আঠারো পাড়ার বহড়া গ্রাম ছিল খুবই বর্ধিষ্ণু জনপদ।সম্পন্ন পরিবারের সন্তান ছিলেন গঙ্গা কিশোর । তাঁর পরিবার ছিলেন শৈবতন্ত্রে বিশ্বাসী। আজও বাড়ির আঙিনায় শিবমন্দির শোভা পাচ্ছে। ছাপাখানার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে এই এলাকায় কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছিল । বহড়া ছাড়াও নতুনগ্রাম, অগ্রদ্বীপ, বড়গাছি, শিমুলতলা সহ বিভিন্ন গ্রামে হাতে তৈরি কাগজ তৈরি হত। নতুনগ্রামের ভাস্কর পরিবাররা কাঠের ব্লক তৈরি করত।জীবনের দীর্ঘ কর্ম পথে নানান বাধা বিঘ্ন পার করে গঙ্গাকিশোর তাঁর নির্ণীত লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন ।বাংলা প্রকাশনা জগতে প্রবাদ পুরুষ বাঙালির বহমান পুস্তক ব্যবসার ঐতিহ্যের জাগর
ষষ্ঠ পৃষ্ঠা
হয়ে বেঁচে থাকলেও ইতিহাসের সেই ছাপাখানা আজ আগাছায় মুখ ঢেখেছে ।গঙ্গাকিশোর বাঙালির অতীত ইতিহাসকে ছাপা অক্ষরে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।ইংরেজ শাসনকালে তীব্র অন্ধকারকে নিজের কলম দিয়ে ব্যঞ্জনাময় আলোর মুখে বাঙালিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। বাংলার প্রথম সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক হয়েও ব্রাত্য হয়ে পড়ে আছে তাঁর সাধের বঙ্গাল গেজেটি ছাপাখানা। বহড়ার ভট্টাচার্য বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছাপাখানার ভবনের শরীর জুড়ে আকীর্ণ ফাটল ,আগাছার জঙ্গলের পাশে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় জীবনের পরতে পরতে আবেগ অনুভূতি বিষাদ, উল্লাস কত কি লুকিয়ে আছে এই ছাপাখানা ডাঙার অলিন্দে। অক্ষরের দল কবে ঘুমিয়ে গিয়েছে বাঙালির প্রথম ছাপাখানা আজ ধ্বংসের প্রহর গুণছে দেখার কেউ নেই ।
তথ্য ঋণঃ
১) সাহিত্য সাধক চরিতমালা , ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২)এশিয়াটিক জার্ণাল , জুলাই ১৮১৯ ,
৩) গঙ্গাকিশোর স্মরণিকা ১৯৯২
৪) কলেজ স্ট্রিট পত্রিকা, বিশেষ বইমেলা সংখ্যা ১৯৮৪
৫) সৈকত মুখোপাধ্যায়, সম্পাদক, হরপ্পা পত্রিকা
৬) দ্বারকানাথ দাস, সাংবাদিক , পাটুলি
৭) চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক, আজকা